বিবেকানন্দ

 

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

ছিন্ন কাঁথা, চীর, স্পর্শে তব ভস্ম হোক,

ঘুচে যাক জড়ত্ববিকার

হে সূর্য্য, প্রণাম লহ মোর

তিমিরবিদারী তব দীপ্ত খর করাঘাতে

ছিন্নভিন্ন হোক মায়াডোর

 

বঙ্গভূমে স্বর্ণবহ্নি ধরি’ মানুষের দেহ,

জন্ম নিল মানবীর ক্রোড়ে,

আগুনে লালন করে, ধন্য সেই মাতৃস্নেহ,

দিগন্তবিসর্পী শিখা ওড়ে

ওড়ে আর পুঞ্জীভূত জঞ্জালেরে করে ছাই,

ভস্মে কালো গৃহাঙ্গন;

জননী সভয়ে চাহে, কোলের সন্তান নাই,

অগ্নিশিখা স্পর্শিল গগন

সে আগুন নাম নিল, বিবেকআনন্দ নাম,

রামকৃষ্ণে অগ্নি করে নতি,

কোলে টানি শিষ্যে, গুরু কহিলেন, বুঝিলাম

শিব, শিব, পতিতের গতি

গুরুশিষ্যে কি ঘটিল ইতিহাসে নাহি লেখা,

গুরু রাখিলেন দেহ তাঁর

দণ্ডধারী বহ্নিশিখা পথে বাহিরান একা,

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

 

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

ছিন্ন কাঁথা, জীর্ণ চীর, স্পর্শে তব ভস্ম হোক,

ঘুচে যাক জড়ত্ববিকার

হে সূর্য্য, প্রণাম লহ মোর

তিমিরবিদারী তব দীপ্ত খর করাঘাতে

ছিন্নভিন্ন হোক মায়াডোর

 

সন্ন্যাসী ভ্রনে একা হিমাচল পাদমূলে,

হাতে দণ্ড, মুণ্ডিত মস্তক,

বিজন পার্ব্বত্যপথে নামিয়া এল কি ভুলে

দেহধারী জ্বলন্ত পাবক!

দেখিয়া সভয়ে সবে ছাড়িয়া দাঁড়ায় পথ,

মনে ভাবে স্বয়ং শঙ্কর

ললাটেতে রাজটীকা, নাহিক সারথীরথ,

নাহি সহস্রেক অনুচর

স্বপ্ন কিম্বা কর্ম্ম দুই ভাবনার মাঝখানে,

সংশয়আকুল তাঁর মন,

তীরের মহারাজা যেন তীরের টানে

পরিয়াছে গৈরিক বসন

হেথা তাঁর কোন কাজধরার ধূসর ধূলি,

তমোময় পঙ্কিল, সংসার

শ্মশানে শঙ্কর চলে বিষানে নিনাদ তুলি

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

 

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

ছিন্ন কাঁথা,জীর্ণ চীর, স্পর্শে তব ভস্ম হোক,

ঘুচে যাক জড়ত্ববিকার

হে সূর্য্য, প্রণাম লহ মোর

তিমিরবিদারী তব দীপ্ত খর করাঘাতে

ছিন্নভিন্ন হোক মায়াডোর

 

আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত ভারত ব্যেপে,

যেন শবদেহ একখান,

রুদ্রের চরণস্পর্শে কঙ্কাল উঠিবে কেঁপে,

তাই কি রুদ্রের অভিযান?

নগ্ন পদে, নগ্ন গায়, যেন আগুনের শিখা

জঞ্জালে ছুঁইয়া গেল স্নেহে,

ভারতের মৃত্তিকার সে লাঞ্ছনাবিভীষিকা

অনুভব করি নিজ দেহে

নয়নে উথলে অশ্রু, অগ্নিজ্বালা বুকে জ্বলে,

শবদুঃখে শিবের ক্রন্দন,

ওপার মুছিয়া যায় পায়ে যত পথ চলে,

প্রিয় হয় এপারের জন

কোথা গুরু রামকৃষ্ণদূরে কন্যাকুমারিকা

সম্মুখেতে নীলাম্বুবিস্তার

মুহূর্ত্তে পড়িল বীর আপন ললাটশিখা

হে বহ্নি তোমারে নমস্কার

 

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

ছিন্ন কাঁথা,জীর্ণ চীর, স্পর্শে তব ভস্ম হোক,

ঘুচে যাক জড়ত্ববিকার

হে সূর্য্য, প্রণাম লহ মোর

তিমিরবিদারী তব দীপ্ত খর করাঘাতে

ছিন্নভিন্ন হোক মায়াডোর

 

সন্ন্যাসী পড়িল জলে মেলি শ্রান্ত ক্লান্ত আঁখি,

ভারতভূমির পানে চায়

কে ডাকিল ‘ওরে বৎস,— কতকাজ আছে বাকি

বাছা মোর কোলে ফিরে আয়

কাঁদিছে তেত্রিশ কোটি রোগে শোকে নিপীড়নে,

রক্তমেঘে ঢেকেছে আকাশ

ভালবাস বুকে নাও, আলো দাও অন্ধজনে

সন্ন্যাসী উঠিল সিক্তবাস

ভারতের মৃত্তিকায় সিক্ত পদচিহ্ন রাখি

ললাটে জুড়িয়া দুই কর

উত্তরে প্রণাম করি’, পশ্চিমে ফিরাল আঁখি,

শিব শিব, শঙ্কর শঙ্কর

ভারতের বাণীমূর্ত্তি দাঁড়াইল রূপ ধরি

মূর্ত্তি ভারতের সাধনার

পূর্ব্বাচল বহ্নিশিখা পশ্চিমে ভাসাল তরী

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

 

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কার

ছিন্ন কাঁথা, জীর্ণ চীর, স্পর্শে তব ভস্ম হোক,

ঘুচে যাক জড়ত্ববিকার

হে সূর্য্য, প্রণাম লহ মোর

তিমিরবিদারী তব দীপ্ত খর করাঘাতে

ছিন্নভিন্ন হোক মায়াডোর

 

পশ্চিমে বিজয়লক্ষ্মী কণ্ঠে দিল জয়মালা,

বিজয়ী ফিরিয়া এল ঘরে,

কে বসিবে সিংহাসনে বক্ষে যার বহ্নিজ্বালা,

নীলাকাশ শিরে ছত্র ধরে!

পীড়িত আর্ত্তের সেবা পতিত অন্ত্যজে প্রীতি

দীনতা ভুলাতে দীনজনে

সংশয়তিমির ছেদি’ ওঠে সন্ন্যাসীর গীতি

ধায় মন পঞ্চবটীবনে:

মন্দির করিয়া আলো মহাকালী যেথা জাগে,

নাচে শ্যামা হৃদয়শ্মশানে

ক্ষুধিত জঞ্জালপুঞ্জে বহ্নির পরশ লাগে,

গুরু জানে আর শিষ্য জানে,

আঁধার গগনবক্ষে ধোঁয়াইয়া ধোঁয়া ওঠে,

বহ্নি চাগে তিমিরবিদার

একটি কমল হতে সহস্র কমল ফোটে

হে বহ্নি, তোমারে নমস্কর

 

(স্বামী বিবেকানন্দের জন্মমাস উপলক্ষে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিতআলো আঁধারি’ গ্রন্থ থেকে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হল)